উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত | Fatimid Khilafat in North Africa

উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত | Fatimid Khilafat in North Africa

উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত | Fatimid Khilafat in North Africa

সপ্তম অধ্যায়- ইসলামের ইতিহাস প্রথম পত্র

উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত Fatimid Khilafat in North Africa

ওবায়দুল্লাহ আল-মাহদী ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে আগলাবীয় ধ্বংসস্তূপের ওপর আব্বাসি খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে উত্তর আফ্রিকায় একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন, যা ফাতেমি খিলাফত নামে পরিচিত। আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠা শিয়া সম্প্রদায়ের প্রথম ও প্রধান রাজনৈতিক সাফল্যের পরিচয় বহন করে। ফাতেমি খিলাফতের শ্রেষ্ঠ খলিফা আল-মুইজের রাজত্বকাল হতে এ খিলাফতের স্বর্ণযুগের শুভ সূচনা হয় এবং আল আজিজের সময় চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ফাতেমি খিলাফতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়, যা তৎকালীন বিশ্বে বিরল। আল আজহার মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং দারুল হিকমা বা বিজ্ঞানভবন এ সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ৯০৯ খ্রিস্টাব্দ হতে ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সর্বমোট ১৪ জন শাসক এ খিলাফত পরিচালনা করেন। তবে দুর্বল ও অযোগ্য খলিফা এবং স্বার্থান্ধ ও কুচক্রী মন্ত্রীদের কুশাসনের ফলে ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে গাজী সালাহউদ্দিন কর্তৃক আল আজিদকে সিংহাসনচ্যুত করার মাধ্যমে ফাতেমি বংশের অবসান ঘটে।

এ অধ্যায়ের পাঠগুলো পড়ে

পাঠ পরিকল্পনা

👉 পাঠ-১ : ফাতেমিদের পরিচয় ও উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ধাপ

ফাতেমিদের পরিচয় ও উত্থান বর্ণনা করতে পারব।

উত্তর আফ্রিকা ও মিসরে ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠার সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির বিবরণ দিতে পারব।

👉 পাঠ-২ : উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমিদের উত্থান,

তৎপরতা ও খিলাফত প্রতিষ্ঠা

ফাতেমি খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আল-মুইজের অবদান মূল্যায়ন করতে পারব।

মিসরে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নয়নে আল

আজিজ ও আল-হাকিমের অবদান মূল্যায়ন করতে পারব

এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উদ্বুদ্ধ হব।

👉 পাঠ-৩ : ওবায়দুল্লাহ আল-মাহদীর পরিচয় ও কার্যাবলি

👉 পাঠ-৪, ৫ ও ৬ : খলিফা আল-কাঈম, আল-মনসুর ও

আল-মুইজ

ফাতেমিদের পতনের কারণ চিহ্নিত করে সেসব বর্ণনা করতে পারব।

👉 পাঠ-৭ : খলিফা আল-আজিজ

👉 পাঠ-৮ : খলিফা আল-হাকিম

উত্তর-আফ্রিকায় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ বর্ণনা করতে পারব।

👉 পাঠ-৯ : ফাতেমি খিলাফতের পতন

👉 পাঠ-১০: ফাতেমিগণ কর্তৃক উত্তর আফ্রিকা ও মিসরে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ

উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত

পাঠ-১

ফাতেমিদের পরিচয় ও তাদের উত্থানের প্রাথমিক অধ্যায় (Introduction of the Fatimid and Initial Phase of their rise)

আরু পড়ুনফাতেমি খিলাফতের পতন (Fall of the Fatimids Khilafat)

ফাতেমিদের পরিচয়

ওবায়দুল্লাহ আল-মাহদীর নেতৃত্বে ৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠিত শিয়া শিলাফতের খলিফাগণ 'ফাতেমি' নামে পরিচিত। তাদের এরূপ নামকরণের কারণ এ বংশের খলিফাগণ নিজেদের ইসলামের চতুর্থ খলিফা ও মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জামাতা হযরত আলী (রা) ও তাঁর স্ত্রী বিবি ফাতেমা (রা)-এর বংশধর হিসেবে দাবি করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মহানবি (স)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরি বা খলিফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজ শিয়া ও সুন্নি এ দু'টি মতাদর্শগত সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মুসলমানদের মধ্যে একটি দল খিলাফতে মহানবির পিতৃব্য ও জামাতা হযরত আলী (র)-এ বৈধ অধিকারের দাবি করেন। তাৎক্ষণিকভাবে তারা হযরত আলী (রা)-এর কাছ থেকে এ ব্যাপারে সমর্থন না পেলেও তারা খিলাফতে হযরত আলী (রা)-এর বৈধ দাবির অবস্থান থেকে সরে যাননি। বরং তারা ক্রমশ নিজেদের সংগঠিত করতে থাকেন। হযরত আলী (রা) খোলাফায়ে রাশেদুনের চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর সমর্থকদের স্বপ্ন পূরণ হয়। কিন্তু তারা এর পূর্বে আরো যে তিনজন মহান খলিফা দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে বৈধ খলিফা হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকার করেন। এভাবে খিলাফতে হযরত আলী (রা)-এর দাবির সমর্থনে মুসলমানদের মধ্যে যে দলের উদ্ভব ঘটে ইতিহাসে তারা 'আলাবী' বা 'শিয়াতু আলী' (আলীর দল) সংক্ষেপে 'শিয়া' নামে পরিচিত।

শিয়া ইমামদের তালিকা

ফাতেমি খলিফাগণের বংশ তালিকা (৯০৯-১১৭১ খ্রি.)

(১) আলী (৬৫৬-৬১ খ্রি.)+ফাতিমা

(১) আল-মাহদী (৯০৯-৯৩৪ খ্রি.)

(২) আল-কাঈম (৯৩৪-৯৪৬ খ্রি.)

(২) হাসান (৬৬১–৬৯ খ্রি.)

(৩) হুসাইন (৬৬৯-৮০ খ্রি.)

(৫) দ্বিতীয় আলী (জয়নুল আবেদীন (৬৮০-৭১২

(৩) আল-মনসুর (৯৪৬-৯৫২ খ্র.)

(৫) মুহম্মদ আল বাকের (৭১২-৩১)

(৪) আল-মুইল (৯৫২-৭৫ খ্র.)

(৫) আল-আগিতা (৯৭৫-৯৯৬ খ্রি.)

(৬) আফর আস-সাদিক (৭৩১-৬৫

(৭) মুসা আল কাজিম (৭৬৫-৯৯

(৭) ইসমাইল (মৃত্যু ৭.)

(৬) আল-কিম (৯৯৬-১০২১ খ্রি.)

মুহম্মদ আল মাকতুম (ফাতেমিদের পূর্বপুরুষ)

(৮) আলী আর রেজা (৭৯৯–৮১৮)

(৯) মুহম্মদ আল জাওয়াইদ (৭৯৯–৮১৮)

(১০) আলী হাদী (৭৩৫–৬৮ খ্রি.)

(১১) হাসান আল আসকারী (৮৬৮–৭৪খ্র.)

*(১২) মুহম্মদ আল মুস্তাজীর (৮৭৪-৭৮ খ্রি.) (*ইনি ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সামাররাহ হতে অন্তর্ধান হন)

(৭) আল-জরি (১০২১-১০৩৫ খ্রি.)

(৮) আল-মুসতানসীর (১০৩৫-১০৯৪ খ্রি.)

(৯) আল-মুসতাদী (১০৯৪-১১০১ খ্র.)

মুহম্মদ

আল-মুস্তাফা মাজার

(১০) আল-আমীর (১১০১-১১৩০ খ্র.)

| (১১) আল-হাফিজ (১১৩০-১১৪৯ খ্রি.)

(১২) আল-ফলাফির (১১৪৯-১১৫৪

(১৩) আল-ফায়েজ (১১৫৪-১১৬০ খ্রি.)

(১৪) আল-আলী (১১৬০-১১৭১ খ্রি.)

২৭৬

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র

খলিফা হযরত আলী (রা)-এর জীবদ্দশায় শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। তবে উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা খলিফা মুয়াবিয়া কর্তৃক আলী (রা) ও ফাতেমা (রা) দম্পতির জেষ্ঠ্য পুত্র ইমাম হাসান (রা) কে খিলাফত থেকে বঞ্চিতকরণ এবং মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াজিদ কর্তৃক কারবালার প্রান্তরে কনিষ্ঠপুত্র ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিয়ারা সুসংগঠিত ও শক্তিশালী হয়। 

অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে ইমামত ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে শিয়া সম্প্রদায় নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এসব দল-উপদলের মধ্যে প্রধান দু'টি উপদল হলো: ১. ইসনা আশারিয়া বা দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী শিয়া দল এবং ২. ইসমাইলীয় বা সপ্তম ইমামে বিশ্বাসী শিয়া দল। উপর্যুক্ত তালিকায় পরিদৃষ্ট ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস-সাদিক পর্যন্ত ইমামদের বিষয়ে শিয়াদের মধ্যে কোনো মত বিরোধ নেই। কিন্তু সাদিকের পরবর্তী ইমামকে কেন্দ্র করে মিয়ারা দ্বাদশ ও সপ্তম ইমামে বিশ্বাসী প্রধান দু'টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

মাম জাফর আস-সাদিক তাঁর জেষ্ঠ্যপুত্র ইসমাঈলকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পূর্বেই ইসমাঈল মারা যান। তখন জাফর আস-সাদিক তাঁর অপর পুত্র মুসা আল কাজিমকে ইমাম মনোনীত করেন। কিন্তু ইসমাঈলের অনুসারীরা মুসাকে সপ্তম ইমাম হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা ইসমাঈলকে সপ্তম ইমাম এবং তাঁর পুত্র মুহাম্মদ আল মকতুমকে তাঁর উত্তরসুরী বলে দাবি করেন।

তারা এও প্রচার করেন যে, ইসমাঈলের পর থেকে জাহেরি বা প্রকাশ্য ইমামতের ইতি ঘটেছে এবং মুহাম্মদ আল মকতুমের মধ্য দিয়ে বাতেনি বা গুপ্ত ইমামত যুগের সূচনা হয়েছে। শিয়াদের এ দলটিই ইতিহাসে ইসমাইলীয় বা সাবাইয়া (সপ্তম ইমামে বিশ্বাসী) বলে পরিচিত। শিয়াদের এ ইসমাঈলীয় উপদলটিই ওবায়দুল্লাহ আল-মাহদীর নেতৃত্বে ৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদের সুন্নি আব্বাসিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উত্তর আফ্রিকায় একটি শিয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। এরা নিজেদের নবিকন্যা হযরত ফাতেমা (রা) এর বংশধর হিসেবে দাবি করায় তাদের প্রতিষ্ঠিত খিলাফতটি ইতিহাসে 'ফাতেমি খিলাফত' নামে সুপরিচিত লাভ করে ।

ফাতেমিদের শাসন এলাকা পরিচিতি: আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উত্তর আফ্রিকায়। তদানিন্তন আরবদের কাছে এ এলাকাটি 'মাগরিব' নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান তিউনিসিয়া থেকে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকীয় ভূ-ভাগকে আবার আরবগণ 'মাগরিব-উল-আকসা' (দূর প্রতীচ্য) এবং লিবিয়া ও আলজেরিয় অঞ্চলকে 'মাগরিব-উল-আওসাত' (নিকট প্রতীচ্য) বলে অভিহিত করতেন। বাবারা জন-জাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়ায় একে অনেক সময় 'বার্বার দেশও বলা হতো। তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া অঞ্চলকে অনেক সময় 'মারকিশ' নামেও ডাকা হতো। এ অঞ্চল এক সময় 'ইফ্রিকিয়া' নামে পরিচিত ছিল এবং এর রাজধানী ছিল 'কায়রোয়ান'। ল্যাটিন ভাষায় ব্যাপক উচ্চারণ বিকৃতি হয়ে ইফ্রিকিয়া নামটি আফ্রিকা নামে পরিচিতি লাভ করেছে বলে ধারণা করা হয়। যা হোক ফাতেমিদের শাসিত উত্তর আফ্রিকা বর্তমানে মিসর, আলজেরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, সুদান ও পশ্চিম সাহারা প্রভৃতি আধুনিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে।

একক কাজ: উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ধাপ উল্লেখ করো।

Read More: ফাতেমিগণ কর্তৃক উত্তর আফ্রিকা ও মিসরে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ